১৯৮৫ সালের জুন মাস। দক্ষিণ আাফ্রিকায় ইতিহাসে এক ব্যাতিক্রমী দিন। সেদিন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ মেয়ে সুজান লেক্লার্ক ও দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল প্রদেশের কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে প্রোটাস ম্যাডলালার বিয়ে হয়েছিল। এটি ছিল প্রথম মিশ্র বর্ণের আইন সম্মতভাবে বিয়ে।
কিন্তু তখনও দক্ষিণ আফ্রিকায় চলছিল বর্ণবাদ শাসন। দুজনের পরিচয় ঘটেছিল আমেরিকার ওয়াশিংটনে। আর বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়।
নাটাল প্রদেশের কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত ছোট্ট শহর সেন্ট ওয়েন্ডারল্যান্ড-এর গির্জায় এই বিয়ে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে বহু মানুষ জড়ো হয়েছিল। একটি সাদা মেয়ে আর এক কালো ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছে, বিয়ের এমন খবর শুনে মাঝপথে জোহান্সবার্গের ট্রেনে ডারবান যাওয়ার পথে কয়েকজন অনুষ্ঠানে দেখতে চলে আসে। সত্যি কি এরকম একটা বিয়ে হচ্ছে? এমন বিয়ে দেখতে শত শত মানুষের ভিড় জমে গেল।
অনেক আগে থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকাতে সাদা ও কালো বর্ণের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল। অন্য বর্ণের মধ্যে বিয়েটাও বেআইনি ছিল। তবে ১৯৮৫ সালের এপ্রিলের দিকে বর্ণবাদের পৃষ্ঠপোষক শাসকরা আইনটির পরিবর্তন করে।
তবু তা বাস্তবে প্রয়োগ হতে আরও সময় লাগে। ওই বছর জুনের প্রথম দিকেও অঞ্চলটিতে মিশ্র বর্ণের বিয়ে অবৈধ ছিল। সেজন্য প্রোটাস ও সুজান বিয়ের দিনও নিশ্চিত ছিলেন না, তাদের বিয়ে আইন সম্মত হবে কি না।
সেই সময় সুজান ক্যথলিক চার্চের জন্য কিছু কাজ করছিলেন আর থাকতেন খিস্ট্রানদের একটি অবকাস কেন্দ্রে। বিয়ের আগের দিনগুলোতে তাঁদের মনে নানা ভয় কাজ করে। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর ও কনে একসাথে গির্জায় যান। নিরাপত্তার স্বার্থে একটি আখ খেতের ভেতরের রাস্তা ধরে সেন্ট ওয়েন্ডারল্যান্ড গির্জায় পৌঁছান।
সেখানে প্রচুর মানুষের ভিড়। তখন এই নব দম্পতির ভয় কেটে তৈরি হল এক আনন্দময় পরিবেশ। উল্লসিত লোকজন গাড়ির দিকে কোর্ট ছুড়ে।
চার্চের বেদির উপর দাঁড়িনোর পর শুনলেন গেল রাতেই আইনটা পরিবর্তন হয়েছে। পরদিন সকালে অনেক জাতীয় দৈনিক ও আন্তর্জাতিক পত্রিকাতেও প্রথম পৃষ্ঠায় তাদের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার প্রথম পাতাতেই তাদের বিরাট ছবি। শিরোনাম ছিল ‘আমাদের প্রথম মিশ্র বর্ণের দম্পতি’।
বৃটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া অনেক দেশে তাদের অনেকগুলো সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছিল। তাছাড়া প্রতিদিন বহুলোক তাদের দেখতে আসত। শেষে একটি পত্রিকায় চিঠি লিখে লোকজনের প্রতি আবেদন জানান, ‘দয়া করে আমাদের একটু নিজেদের মত থাকতে দিন’। কিছুদনি পরে অবশ্য এই ঝামেলাটা কমে গেল।
কিন্তু শেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বিয়ে আইনসম্মত হয়ে গেলেও দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য অনেক ক্ষেত্রে বর্ণ বৈষম্য রয়ে গিয়েছিল। তারা দুজনে দোকানে কেনাকাটা করতে যেতে পারেনি। লোকজন বাকা চোখে তাকাত। তাই তারা সহজে শেতাঙ্গ অধ্যুষিত ডারবান শহরে যেতেন না। ঝামেলা এড়াতে কাজের পর তাদের দেখা হত কারপার্কে। কৃষ্ণাজ্ঞ বাস চালক তাকে বাসে উঠতে দিতে ভয় পেত। অনেক বছর তাদের আলাদা থাকতে হয়েছে।
শেতাঙ্গ অধ্যুষিত শহরে ভালো কোন বাড়ি পায়ন। তাছাড়া সুজানা বিদেশি ছিল বলে সে কোন চাকরি পায়নি। ডারবান থেকে ৫০০ কিলোমটিার দূরে তাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজ নিতে হয়েছিল। তরুণ দম্পতি হলেও মাসে দুমাসে একবার দেখা হত। তারপর যখন সস্তান হল এবং যখন তাকে নিয়ে বেরুলে লোকে তাকে আপাদমস্তক দেখত। আর লোকে বিশ্বাস করতে পারত না যে সে একজন কালো লোকের সন্তান পেটে ধরেছে।
এই দম্পতির বিবাহিত জীবন স্থায়ী হয়েছিল ১৮ বছর। বিচ্ছেদের পর প্রোটাস দক্ষিণ আফ্রিকায় আর সুজান আমেরিকা বসবাস করেন। কয়েক দশক পার হয়ে যাওয়ার পর তিনি এবং তার সাবেক স্বামী যে সংগ্রাম করেছেন তা পরবর্তীকালের মিশ্র বর্ণের দম্পতিদের পথ সুগম করেছে।
প্রোটাস ও সুজানের বিয়ের খবর দক্ষিণ আফ্রিকার সবগুলো জাতীয় দৈনিক এবং অনেক আন্তর্জাতিক পত্রিকাতেও প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সব দেশে তাদের সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছিল।