আবারও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে। যেখানে বাংলাদেশে চরমপন্থী হামলা এবং সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তবে এর সরাসরি কোনো জবাব দেননি মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস। তবে ট্রাম্প প্রশাসন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেকোনো বিষয় কূটনৈতিক সমাধানের প্রতি সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানান।
স্থানীয় সময় সোমবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস।
ব্রিফিংয়ে প্রশ্নকারী দাবি করেন, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বাংলাদেশে আসন্ন ইসলামপন্থী চরমপন্থী হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। সন্ত্রাসবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে আরেকটি আফগানিস্তানে পরিণত হওয়া থেকে রোধ করতে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? এ ছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের অধীনে সাংবাদিকের বেআইনি কারাদণ্ডের বিষয়টি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখছে এবং বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য মার্কিন সরকার কীভাবে কাজ করছে?
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমরা যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হই, আমার মনে হয় আমরা অন্যান্য দেশগুলোকে কীভাবে পরিচালনা করি, তাদের বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করলে তাদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করি, যদি আমরা তাদের আমাদের বন্ধু মনে করি, তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলোতে ফিরে যাই তা হলো- কূটনৈতিক পরিস্থিতি।’
তিনি বলেন, ‘সৌভাগ্যবশত আমাদের এমন একটি প্রশাসন এবং একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন যিনি কূটনৈতিক সমাধানের প্রতি সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বিশ্বজুড়ে আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি কথোপকথন করেন এবং অবশ্যই আমাদের শক্তির বিষয়েও প্রভাব ফেলেন।’
ট্যামি ব্রুস আরও বলেন, ‘আমাদের প্রেসিডেন্ট- যিনি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার জন্য পরিচিত- তিনি জানেন, আমরা প্রতিটি দেশ, অবশ্যই বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে মানবাধিকারের নিয়ম মেনে চলার এবং তাদের নিজস্ব নাগরিকদের তাদের সরকারের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করে সে সম্পর্কে সচেতন এবং ন্যায্য হওয়ার প্রত্যাশা করি।’
কানাডায় পালিয়েছেন মরক্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত
মরক্কোয় দায়িত্বরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হারুন আল রশিদ কানাডা পালিয়ে গেছেন। তিনি সেখানে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী এবং ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার পক্ষে লেখালেখি করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিগত সরকারের অনুচরদের প্রশ্রয় ও পুনর্বাসন না করা হলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ এবং আমার জন্য একটি আবেদন। বিষয়: ড. ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশের নৈরাজ্যের দিকে পতন– বিশ্বের নীরবতা বেদনাদায়ক’ শীর্ষক এক স্ট্যাটাস দেন। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈধ সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মোহাম্মদ হারুন আল রশিদ লেখেন, ‘মানবতার বিবেকের উদ্দেশে: বাংলাদেশ আজ নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছড়িয়ে দেওয়া বর্বরতার শিকার। লাখো মানুষ এক ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি– মৃত্যু, নির্বাসন, অথবা উগ্রপন্থার কাছে আত্মসমর্পণ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, দেশটি তার ইতিহাসের এক অন্ধকারতম অধ্যায়ের মুখোমুখি হয়– একটি সুপরিকল্পিত সন্ত্রাসী আক্রমণ, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈধ সরকারকে উৎখাত করে বাংলাদেশের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। যখন দেশ জ্বলছিল এবং শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছিল, মুহাম্মদ ইউনূস তখন আত্মপ্রকাশ করেন দখলদার হিসেবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত জিহাদিরা যেমন ফরহাদ মজহার ও জাহেদুর রহমান– শেখ হাসিনার বাক্স্বাধীনতার নীতির সুযোগ নিয়ে উগ্রপন্থার প্রচার চালিয়েছে। তারা হিন্দু ও ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছে, শুধুমাত্র এই কারণে যে, শেখ হাসিনার শাসনে বাংলাদেশের হিন্দুরা নিরাপদ ছিল। তাদের মিথ্যাচার বাংলাদেশি মুসলিমদের মনে ভারতবিদ্বেষকে এক মানসিক ব্যাধিতে পরিণত করেছে, যা উগ্রপন্থার পথ সহজ করে দিয়েছে।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিচয় ধ্বংস: ইউনূসের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই জিহাদিরা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ধ্বংস করেছে, ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে দিয়েছে। তারা শুধু জাদুঘর, ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও সাংস্কৃতিক প্রতীক ধ্বংস করেনি; শত শত সুফি দরগাহ এবং হিন্দু মন্দিরও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ইউনূসের শাসনে বাংলাদেশ নারীদের প্রতি সবচেয়ে নির্যাতনমূলক দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, আর হিযবুত তাহ্রীর, আইএস ও আল কায়দা প্রকাশ্যে তাদের লাল-কালো পতাকা উড়িয়ে ইসলামী খেলাফতের দাবি জানাচ্ছে। জুলাই-আগস্ট মাসের সন্ত্রাসীরা এদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু ড. ইউনূস শুধু তাদের রক্ষা করেননি– তাদের ক্ষমতাও দিয়েছেন। তার সরকারে সন্ত্রাসীরা মন্ত্রী হয়েছে, আর যাদের তিনি মন্ত্রিত্ব দিতে পারেননি, তাদের রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ করে দিয়েছেন।’
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে কূটনীতিকের এমন মন্তব্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, যে সরকারই এসেছে, তারাই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ৫ আগস্টের পর পুরো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজানোর সুযোগ এসেছিল। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিব বিগত আমলে যেসব কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তারাই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে রেখেছেন। সেই সঙ্গে এসব কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় ভালো ভালো পোস্টিং নিয়ে বিদেশে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ব্যর্থতা। আর কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই এখানকার শীর্ষ কর্মকর্তাদের।
পরে এ ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুক্রবার একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মরক্কোয় বাংলাদেশের সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রদূত হারুন আল রশিদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বছর ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রত্যাবর্তন ও অনতিবিলম্বে মন্ত্রণালয়ে যোগদানের জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল। এ সত্ত্বেও তিনি তাঁর পদে বহাল থেকে চলতি বছর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার পরিবর্তে তিনি বিভিন্ন অজুহাতে তাঁর যাত্রা বিলম্বিত করেন। মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন ছাড়াই তিনি মরক্কোর রাবাত থেকে কানাডার অটোয়ায় চলে গেছেন। ৬ মার্চ তাঁর অটোয়া থেকে ঢাকায় ফিরে আসার কথা থাকলেও তিনি ফেরত আসেননি।
ফেসবুক পোস্টে তিনি ফ্যাসিবাদী সরকারের গুণকীর্তনের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ, প্রচেষ্টাসহ দেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং বাস্তবতাকে সম্পূর্ণরূপে বিকৃত উপস্থাপন করে ফেসবুকে এ ধরনের লেখা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং এর বিষয়বস্তু গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এ রূপ উদ্দেশ্য বা অসৎ অভিসন্ধির ইঙ্গিত দেয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে তার এবং পরিবারের পাসপোর্ট বাতিলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মন্ত্রণালয় এ কূটনীতিকের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।